🌧️ বৃষ্টিভেজা বিকেলে — পর্ব ১
রচনা: Mukul Mia
ঢাকার এক পুরনো পাড়া, ভিড় আর শব্দে ক্লান্ত একটা দুপুর ধীরে ধীরে বিকেলে গড়াচ্ছে। মেঘ জমেছে আকাশে, গলির মাথায় একটা পুরনো বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ইশরাত। বয়স তেইশ হবে, সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছে। শান্ত স্বভাবের মেয়ে, নিজের মতো থাকা পছন্দ করে।
আজ তার কাছে নতুন একজন ছাত্র আসবে। নাম তামিম, বয়স ১৭, এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। তার মা বলেছিলেন—
"ম্যাডাম, ছেলেটা একটু আনমনা। আপনি একটু যত্ন করে পড়াবেন।"
ইশরাত হালকা হাসলেন, "আমি চেষ্টা করব আন্টি।"
সন্ধ্যার একটু আগে তামিম এল। সাদা শার্ট, ভেজা চুল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে হালকা করে।
ইশরাত বলল,
"ভিজে গেছো, গা ভিজা কাপড় পরে পড়া ঠিক না। ভিতরে এসে তোয়ালে দিয়ে মুছে নাও, আমি চা এনে দিচ্ছি।"
তামিম চুপচাপ মাথা নাড়ল। তার চোখে-মুখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন এই ছিমছাম বাসাটা তার খুব আপন।
ইশরাত চা এনে দিল, দুজনের মধ্যে হালকা কথোপকথন শুরু হলো।
"তুমি কী বিষয়ে পড়তে বেশি পছন্দ করো?"
"ইংরেজি ভালো লাগে, কিন্তু অঙ্ক একদম বুঝি না।"
ইশরাত হেসে বলল, "তাহলে আজ ইংরেজি দিয়ে শুরু করি?"
তামিম তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তার দৃষ্টিতে ছিল কৃতজ্ঞতা।
“আপনার মতো কেউ যদি পড়াতো আগেই, হয়তো সবকিছুই সহজ লাগতো।”
বৃষ্টির শব্দ বেড়ে গেল। বাইরের পৃথিবী নীরব হয়ে এল। সেই নীরবতার মধ্যে বইয়ের পাতার শব্দ, চায়ের কাপের ধোঁয়া আর দুজন মানুষের শান্ত অথচ আন্তরিক উপস্থিতি — এক অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি করল।
“তুমি পড়ানোর সময় খুব শান্ত থাকো,” হঠাৎ তামিম বলে উঠল।
ইশরাত একটু চমকে তাকাল, তারপর মৃদু হেসে বলল,
“রেগে পড়ালে তো কেউ শিখবে না। তুমি ধীরে ধীরে বুঝবে সব।”
তামিম একটু হেসে মাথা নিচু করল। কিছু সময় চুপচাপ কাটল।
“আপনি কি এই বাসায় একা থাকেন?”
ইশরাত একটু থেমে বলল,
তামিম মাথা নিচু করে বলল, “আপনাকে দেখে বুঝা যায় আপনি অনেক কিছু সহ্য করে বড় হয়েছেন।”
এই কথাটা শুনে ইশরাত একটু চুপ করে থাকলো। কিছু আবেগ চেপে রেখে সে শুধুই বলল,
“সবাই তো কিছু না কিছু সহ্য করে… তুমি কেমন আছো? তোমার বাবা-মা?”
তামিম একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিল।
“আমার মা আছেন, কিন্তু বাবার সাথে সম্পর্ক ভালো না। ঘরে শান্তি নেই… তাই আপনার কাছে পড়তে এসে একটু ভালো লাগে।”
এবার ইশরাত সত্যিই কিছু বলতে পারল না। অদ্ভুত এক নীরবতা ঘিরে ধরলো ঘরটিকে।
হঠাৎ বাইরের বাতাসে জানালার পর্দা উড়তে লাগলো। ইশরাত উঠে গিয়ে পর্দা ঠিক করল। তামিম তাকিয়ে রইলো— তার চোখে ছিল শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা, এবং কিছু না বলা কথা।
“চলো আজ এতটুকু পড়া হলো। আজকের মতো থাক।”
ইশরাত বলল, তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত কোমলতা।
তামিম বই গুছিয়ে বলল,
“আমি কি কাল আসতে পারি আবার?”
ইশরাত একটু চমকে তাকাল, তারপর বলল,
“তুমি প্রতিদিনই আসো, তাতে আমারও ভালো লাগে।”
সপ্তাহ কেটে যাচ্ছে।
তামিম এখন নিয়মিতই আসে। পড়ার চেয়ে বেশি সময় গল্প হয়। বইয়ের পাতার ফাঁকে জমা হয় কিছু চুপ থাকা অনুভূতি। ইশরাত বুঝতে পারছে— ছেলেটা তাকে কেবল শিক্ষিকা হিসেবে দেখে না আর।
একদিন সন্ধ্যায়, যখন ঘরে শুধু মৃদু বাতাস আর মোমের আলো, তামিম বলল,
“ইশরাত আপু... আপনাকে আমার খুব কাছের মনে হয়। অনেক বেশি।”
ইশরাত চুপ। কণ্ঠ শুকিয়ে গেল।
তার মাথায় ঘুরছে সমাজ, বয়সের পার্থক্য, নিজের দায়িত্ব।
সে আস্তে বলল,
“তুমি এখনো ছোট, তামিম। এই অনুভবটা হয়তো সময়ের একটা মায়া।”
তামিম কিছু বলল না। শুধু বলল,
“আপনি কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?”
ইশরাত একটু কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, একসময়। কিন্তু ভালোবাসা সবসময় ঠিক সময়ে আসে না। কেউ কেউ জীবনে আসে, আবার চলে যায়।”
ঠিক তখনই দরজায় শব্দ।
ইশরাত দরজা খুলতেই সামনে এক ভদ্রলোক— বয়স ৩০-এর কাছাকাছি, স্মার্ট, পরিপাটি।
“তুই এখনো এমনই আছিস, ইশু?” – বলে হেসে ফেলল।
তামিম অবাক। ইশরাত একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
“এই তানভীর... হঠাৎ?”
“ঢাকায় কাজে এসেছি, ভাবলাম তোকে দেখি। এখনো কি সেই পুরোনো বই আর বৃষ্টিতে সময় কাটাস?”
তামিম চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সে বুঝে যায়, এই মানুষটার সাথে ইশরাতের একসময় কিছু ছিল।
তানভীর ঢুকে পড়ে ঘরে, যেন জায়গাটা তার চেনা।
তামিম কেটে পড়তে চায়, কিন্তু ইশরাত বলল,
“তুমি চাইলে থাকো, আজ একটু অন্যরকম পড়া হবে।”
তামিম বলল না কিছু। চুপচাপ ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বৃষ্টি থেমে গেছে। জানালার কাঁচে জল জমে রয়েছে এখনো। তামিম বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে, কিন্তু মাঝে মাঝে তার চোখ চলে যায় ইশরাতের দিকে।
ইশরাত হালকা সালোয়ার-কামিজ পরে বসে আছে টেবিলের পাশে, কাঁধে চুল এলোমেলোভাবে ঝুলছে। সে ধৈর্য ধরে তামিমকে বুঝিয়ে দিচ্ছে শব্দের ব্যবহার, টেনস, আর বাক্য গঠন। সময় যেন থেমে গেছে।
“না, মা আছেন। উনি পাশের রুমে আছেন এখন। আমি ছোটবেলায় বাবাকে হারাই। এরপর থেকেই মা-ই আমার সব।”
পরদিন বিকেল।
আকাশে তখনো মেঘ, মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে হালকা করে। ইশরাত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে চা খাচ্ছে। তার চোখে কিছু ভাবনার ছাপ — গতকালের কথা মনে পড়ছে, তামিমের চোখে সেই গভীর দৃষ্টি, যেটা শুধু একজন মনের মানুষকে দেখলেই হয়।
ঠিক তখনই দরজার বেল।
ইশরাত দরজা খুলতেই তামিম। তার চোখে হাসি, কিন্তু কণ্ঠে লাজুক ভঙ্গি:
“আপনার জন্য একটা বই এনেছি। আপনি তো কবিতা পছন্দ করেন, তাই ভাবলাম…”
ইশরাত অবাক হয়ে বইটা হাতে নিল — জীবনানন্দ দাশের কবিতার সংকলন।
“তুমি জানলে কী করে?”
“আপনার টেবিলের ওপর দেখেছিলাম, আর... আপনি যেমন করে কথা বলেন, তাতে বুঝতে কষ্ট হয় না,” বলে তামিম একটু হেসে ফেলে।
ইশরাতের মুখে ধরা পড়ে হালকা লজ্জা আর বিস্ময়।
“তোমার বয়স তো বেশি না, কিন্তু অনেক অনুভব শক্তি আছে।”
তামিম আস্তে আস্তে বলল,
“আমি ছোটবেলা থেকেই একা। তাই মানুষকে দেখেই অনুভব করি কে আসল, কে নয়।”
পড়াশোনা শুরু হলো। কিন্তু আজকের পড়া যেন কেমন ধীর— দুজনেই যেন অন্য কিছুর মধ্যে ডুবে আছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। পুরো ঘর মেঘলা আলোয় ঝাপসা হয়ে গেল। বাইরের বৃষ্টির শব্দ বাড়ছে।
ইশরাত মোমবাতি জ্বালাতে গেল, কিন্তু ম্যাচ খুঁজে পেল না।
তামিম এগিয়ে এসে নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট লাইটার বের করল।
মোমবাতি জ্বালিয়ে দিতে দিতে তার আঙুল ইশরাতের আঙুল ছুঁয়ে গেল।
এক মুহূর্তের জন্য সময় যেন থেমে গেল। দুজনেই চুপ। চোখে চোখ। নিঃশব্দে কিছু কথা বিনিময় হয়।
তারপর ইশরাত আস্তে করে বলল,
“তুমি আজ একটু বড় হয়ে গেলে তামিম।”
তামিম কিছু বলল না। শুধু বলল,
“আপনার জন্য বড় হতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
0 Comments